রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের অধীনে আবাসিক ভবন নির্মাণ কাজের অনিয়মের জন্য বহুল আলোচিত ‘বালিশকাণ্ডের’ মূল হোতারা থেমে নেই। কল্পনাতীত দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং পাত্রবিশেষে শাস্তির পরও বন্ধ হয়নি তাঁদের অপতৎপরতা। এমনকি জেলে বসেও অনৈতিকভাবে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। এদিকে ওই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের নামমাত্র শাস্তি দেওয়া, এমনকি কাউকে কাউকে শাস্তি না দেওয়া নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন ভবনের জন্য ২০১৮ সালে প্রতিটি বালিশ কেনা হয়েছিল পাঁচ হাজার টাকায়। আর একেকটি বালিশ ২০ তলা ভবনে ওঠানোর মজুরি ধরা হয়েছিল ৭৬০ টাকা। শুধু বালিশ নয়, বাজারমূল্যের সঙ্গে সংগতি না রেখে খাট, বিছানার চাদর, ড্রেসিং টেবিলসহ বিভিন্ন পণ্য কেনায় ধরা হয়েছিল কয়েক গুণ দাম। বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে আসার পর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্তে বেরিয়ে আসে সব পণ্যের মূল্য মোট ৩৬ কোটি টাকা বেশি ধরা হয়েছিল।
এই অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৩৪ কর্মকর্তা জড়িত থাকার কথা জানিয়েছিলেন তখনকার গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। তিনি বলেছিলেন, তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ ঘটনায় অতিরিক্ত ৩৬ কোটি ৪০ লাখ ৯ হাজার টাকা নিয়েছে। এদিকে তদন্ত কমিটি অভিযুক্তদের নাম প্রকাশ করে। কমিটির প্রতিবেদন ও সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে গণপূর্ত বিভাগের পাবনার নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলমসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে গ্রেপ্তার করেছিল দুদক। এদিকে টাকা ফেরত না দিলে পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সাজিন কনস্ট্রাকশন ও মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশনকে নিষিদ্ধ করা হবে—মন্ত্রণালয়ের এমন হুমকির মুখে ৩৬ কোটি টাকা ফেরত আসে সরকারি কোষাগারে।
দুদকের তদন্তে বেরিয়ে আসে পাবনা গণপূর্ত বিভাগের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমানে রিজার্ভ, সেগুনবাগিচা) মাসুদুল আলম, তিন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী তাহাজ্জুদ হোসেন, আহমেদ সাজ্জাদ খান ও মোস্তফা কামাল, উপসহকারী প্রকৌশলী আবু সাইদ, জাহিদুল হক, শফিকুল ইসলাম ও রওশন আলী, সহকারী প্রকৌশলী সুমন কুমার নন্দী, মোর্শেদ তারেক এবং দুই ঠিকাদার সাজিন কনস্ট্রাকশনের মালিক শাহাদাত হোসেন ও মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশনের মালিক আসিফ হোসেনের নাম।
তবে এই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ধরনে অনেক প্রশ্নের জন্ম নেয়। আলোচিত প্রকল্পটিতে তিনটি প্রাক্কলনে সুপারিশ করেছিলেন রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ কে এম জিল্লুর রহমান। তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও চাকরিতে বহাল রাখা হয়েছে ছয়টি প্রাক্কলনে সুপারিশকারী পাবনা গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী দেবাশীষ চন্দ্র সাহাকে। এভাবে আরো বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মকর্তাদের দেওয়া শাস্তির বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা এখন সরগরম।
জানা গেছে, বালিশকাণ্ডে জেলে যাওয়া দুই ঠিকাদার একাধিকবার জামিনের আবেদন করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। পরে কৌশলে জামিন পেতে তাঁরা হাইকোর্টে আবেদনে বলেছিলেন, তাঁরা জেলে থাকার কারণে প্রকল্পের কাজে বিঘ্ন ঘটছে। জামিন দিলে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করা যাবে বলেও আবেদনে উল্লেখ করেছিলেন। তবে এতে আপত্তি জানিয়ে দুদক বলেছিল, যাঁদের কারণে বালিশকাণ্ডের মতো আলোচিত ঘটনাটি ঘটেছিল, তাঁদের জামিন না দিলে প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্ত হবে—এটি খুবই হাস্যকর ও হটকারী বক্তব্য।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের মার্চে ১৭টি ভবন নির্মাণসহ মোট ৩১টি কাজের আলাদা দরপত্র আহ্বান করে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। মোট ৪৮০ কোটি ৬০ লাখ টাকার কাজের জন্য বহু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয়। এর মধ্যে ১০ তলা ছাত্রী হল নির্মাণের দরপত্রে চারটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। কিন্তু সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে পাশ কাটিয়ে কাজটি দেওয়া হয় সাজিন কনস্ট্রাকশনকে। আতাউর রহমান খান-জিন্নাত আলী জিন্নাহ লিমিটেড সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ৪৮ কোটি ৯৩ লাখ ৫৫ হাজার ৩৩৭ টাকায় কাজ নিতে প্রস্তাব দেয়। সাজিন প্রস্তাব করে ৪৯ কোটি ১৯ লাখ ৯৩ হাজার ৩৭৮ টাকা। ২৬ লাখ ৩৮ হাজার ৪১ লাখ টাকা বেশি দর প্রস্তাব করেও কাজটি পায় সাজিন। এতে দেখা দেয় বিস্ময়।
পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ তলা প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের দরপত্রে পাঁচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এর মধ্যে সর্বনিম্ন ৩০ কোটি ৫৪ লাখ ১০০ টাকা দর প্রস্তাব করে আতাউর রহমান খান-জিন্নাত আলী জিন্নাহ (জেবি)। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ৬৩ লাখ ৮৬ হাজার ৫৮৯ টাকা বেশি দর প্রস্তাব করার পরও কাজের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে শাহাদাত হোসেনের সাজিন কনস্ট্রাকশনকে। শুধু এ দুই কাজই নয়, অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির মোট ৪৮০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজের মধ্যে প্রায় পুরোটাই শাহাদাতের সিন্ডিকেটের ঠিকাদাররা পেয়ে যান।
এদিকে এ প্রকল্পে আত্মসাত্কৃত ৩৬ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত আসার মাধ্যমে দুর্নীতির সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চিঠির মাধ্যমে প্রশ্নের জবাবে আত্মসাত্কৃত টাকা ফেরতের তথ্য জানিয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। দুদকের আইনজীবী বলছেন, আত্মসাতের টাকা ফেরত দেওয়ার মানেই হচ্ছে, অপরাধীরা অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, বালিশকাণ্ডে ৩৬ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে; যা আবার ফেরতও এসেছে। সরকারের অন্য অনেক খাতে নীরবে যে বড় বড় দুর্নীতি হয়ে যায়, তার তুলনায় এই অঙ্ক কিছুই নয়। কিন্তু এ ধরনের আলোচিত ঘটনা দুর্নীতির ধারণাসূচকে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিষয়টি ইতিবাচক বলে মনে করছে টিআইবি। তবে সরকারি খাতগুলো থেকে দুর্নীতির ঐতিহ্য দূর করার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিজ্ঞাপন