“মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাচিবারে চাই।” বেচে থাকার তীব্র আকাঙ্খা নিয়েই লিখেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নিজের সকল ঝামেলা কে হারিয়ে পৃথিবীর বুকে বেচে থাকার নামই জীবন। মানবজীবনে প্রতিকূলতা আসাটাই স্বাভাবিক।এই প্রতিকূল পরিবেশ কে হারিয়ে বেচে থাকতে হয় মানুষ কে। প্রত্যেক টা মানুষের জীবনে চিন্তা রয়েছে। কারও চাকরির চিন্তা, কারও লেখাপড়ার চিন্তা, কারও পরিবারের চিন্তা কারও আবার ভাতের চিন্তা। এখন সব চিন্তার শেষ পরিণতি যদি আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ কিছু হয় তবে খুব শীঘ্রই এই সমাজ বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ঘনঘন আত্মহত্যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় পুথিগত বিদ্যায় সব নয়। এর সাথে ধর্মীয় শিক্ষাটাও অত্যন্ত জরুরী।
মানসিক অবসাদ থেকে সহজ ও মুক্তির পথ হিসেবে আজকাল আত্মহত্যাকে বেঁচে নিচ্ছে দেশের সার্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের অনেকেই। উদ্বেকজনক হারে বাড়ছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা। কয়দিন পরপর এমন ঘটনা আমরা দেখছি। সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া কয়েকজনের আত্মহত্যার খবর প্রকাশ পায়। বিভিন্ন কারণে এইসব ঘটনা ঘটছে। এই আত্মহত্যার ঘটনাগুলো আমাদের ভাবিয়েছে এবং ভাবাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা সমাধানে আত্মহত্যাই একমাত্র পথ নয়। বেঁচে থাকার আকুতি প্রতিটি জীবের সহজাত প্রবৃত্তি । পরিবেশের সাথে লড়াই করে কীভাবে টিকে থাকতে হয় তার কৌশল জীবের মধ্যে লুকিয়ে আছে। সব মানুষই বাঁচতে চাই। তারপরও কিছু মানুষ আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেই। বেঁচে থাকা তাদের জন্য এতোটাই কষ্টের হয় যে, মরে যাওয়ার মাধ্যমে মুক্তির স্বাধ খুঁজে তারা। নারী আত্মহত্যার চেষ্টা করে বেশি, কিন্তু আত্মহত্যার কারণে মৃত্যু বেশি হয় পুরুষের।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে আট লক্ষেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। যার অর্থ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও একজন মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন। এছাড়াও আরো বহুগুণ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। সারা বিশ্বে যত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে তার ৭৫ শতাংশ হয়ে থাকে নিম্ন বা মধ্য আয়ভুক্ত দেশগুলোতে। এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান হলো দশ নম্বরে।গোটা দুনিয়ায় ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যাই মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ। ২০১২ সালের পরিসংখ্যান অনন্ত এরকমই বলছে।
এতো আত্মহত্যার কারণ হিসেবে ধরা হয় মূলত বেকারত্ব, মানসিক চাপ,তীব্র বিষন্নতা, একাকিত্ব, পারিবারিক জটিলতা,সম্পর্কের অবনতি, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, আর্থিক সংকটকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে সেশনজটে পড়ে পিছিয়ে যাওয়া, চাকরি পাওয়ার অনিশ্চিয়তা, পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা এইসব কারণে বিষন্নতা তৈরী হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। যা আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। তাছাড়া মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে আমরা উদাসীন। কেন যেন মানতেই পারি না ভালো মন্দ যাই ঘটুক, সেটি জীবনেরই অংশ। জীবনটা অনেক মূল্যবান। আমাদের নিজেদের সচেতন হতে হবে। আত্মবিশ্বাস না হারিয়ে ধৈর্য্যশীল হতে হবে। প্রতিযোগিতা নয় বরং সহযোগিতাই পারে পৃথিবীটাকে বদলে দিতে। একটি মানুষ আত্মাহত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তখন তার মধ্যে জ্ঞান বুদ্ধি কাজ করে না। কত তুচ্ছ কারণেই না মানুষ আত্মহত্যা করে। ভাবতেই ভীষণ দুঃখ লাগে।
এখন আসা যাক, সেই প্রসঙ্গে যা আত্মহত্যার হার কমাতে সহায়ক হবে। প্রথমত, রাষ্ট্রের প্রাণ হিসেবে এর নাগরিকদের ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী’ কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। বেকারত্ব দূরীকরণে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং একজন শিক্ষার্থী যতদিন বেকার থাকবে তাকে বেকারত্ব ভাতা’র আওতায় আনতে হবে। এছাড়া বেকার জনগোষ্ঠী যেন হেয় প্রতিপন্ন না হয় তার নিমিত্তে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক অসচ্ছল শিক্ষার্থীকে প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে যেন একজন শিক্ষার্থীও অর্থাভাবে ঝরে না পড়ে। বাল্য বিবাহসহ ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ের বিরুদ্ধে কঠোর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে, রাষ্ট্রের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে যা ইতিমধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে।
তৃতীয়ত, আমাদের অভিভাবকদের বুঝতে হবে যে, আমাদের ইচ্ছে বা জেদের থেকে আমাদের সন্তানের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। তাই বিবাহের ক্ষেত্রে তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যেন প্রেমে ব্যর্থতার মতো কারণে আর একজন মানুষও আত্মহত্যা না করে।
চতুর্থত, রাষ্ট্রকে নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে ভূমিকা রাখা বিভিন্ন উপাদান যেমন, পার্ক, খেলার মাঠ, থিয়েটার, পাবলিক লাইব্রেরি ইত্যাদির সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
পরিশেষে, সময় বদলে গেছে। তার সাথে পাল্টে গেছে আমাদের জীবন ধারা। তাই আমাদের আরও ভাবতে হবে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে। ইন্টারনেট আসক্তি, সমাজের অরাজকতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, চাকরিজীবী অভিভাবকের সন্তানের জন্য সময় কম দেওয়া, প্রিয়জনের সাথে দূরত্ব বেড়ে যাওয়া, ফেসবুকের বিমূর্ত বন্ধুর মাঝে বুদ হয়ে থেকে সামনের বন্ধুকে ভুলে যাওয়া, ভিডিও গেমসের জগতে গিয়ে বিকেলে মাঠের ফুটবলের চল হারিয়ে যাওয়ার মতো কারণগুলোকে নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের।
আমাদের বিষণ্ন লাগতেই পারে। এই বিষণ্ন লাগা, হতাশ লাগা এগুলো কোনো বড় ঘটনা নয়। শরীরের রোগের মতো মনের রোগের চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে আমাদের সচেতন প্রয়াস আরও বাড়াতে হবে। আমাদের মনের যত্ন নিতে হবে। সব থেকে বেশি যা দরকার তা হলো, আমাদের আত্মবিশ্বাসের জায়গাকে মজবুত করতে হবে।
জীবনে আঘাত, দুঃখ, বেদনা, কষ্ট আসে জীবনকে শক্ত করার জন্য; মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য নয়। মনে রাখতে হবে, মৃত্যু আমাদের জীবনের লক্ষ্য নয়, বেঁচে থাকাটাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য। আমরা চাই, মানুষ নিজেকে ভালবেসে বেঁচে থাকুক, আত্মহত্যার এই দুঃখগাঁথার ইতি ঘটুক।
শাদমান ইয়াসার, ছাত্র, আইন বিভাগ, ইবাইউবি।