নারী জাগরণে বেগম রোকেয়া » Itihas24.com
ঈশ্বরদী২৬শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
ঈশ্বরদীর সবশেষ নিউজ । ইতিহাস টুয়েন্টিফোর

নারী জাগরণে বেগম রোকেয়া

রনজন কুমার
ডিসেম্বর ৯, ২০২৩ ১২:৩১ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ঊনিশ শতকের শেষের দিকে মুসলমানদের জাতীয় জীবনে আসে এক চরম যুগ সন্ধিক্ষণ। সে যুগে পুরুষশাসিত সমাজে সমগ্র মুসলিম নারীসমাজে বিরাজিত দুঃখ-দুর্দশা তাপ-গ্লানি-শাপাভিশাপের বেড়াজাল থেকে এবং পুরুষের কামনা-বাসনার একমাত্র পুতুল, হাতে-পায়ে বেড়ি দেওয়া নারীসমাজকে যিনি দেখিয়েছিলেন সুর্যের মুখ, যিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন নারীদের সম্পূর্ণ আলাদা সত্তা নিয়ে পৃথিবীতে বিচরণের, যিনি মোমবাতির মৃদু আলোকশিখায় আলোকিত করেছিলেন নারীর মুখাবয়ব, যিনি শীলনোড়া ঠেলেও নারীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন বর্ণ পরিচয়ের ছবি, যিনি দেখিয়েছিলেন নারীর অন্ধ দু’চোখে জ্ঞানের আলো, যিনি শুনিয়েছিলেন- ‘জাগো বংগবাসী/দেখো কে দুয়ারে/ অতি ধীরে ধীরে/ করে করাঘাত’।

বেগম রোকেয়া এমনই এক মহীয়সী নারী যিনি তার যুগে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। কিন্তু তার যুদ্ধে তার হাতে ছিল না কোনো ঢাল, ছিল না শাণিত তরবারি, ছিল না গোলন্দাজ, অশ্বারোহী। তার হাতে প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই তাতে কি? তার ছিল শাণিত বাক্যবাণ। আর ছিল ক্ষুরধার লেখনী। বিন্দুমাত্র নিরাশ না হয়ে বরং স্বীয় বিশ্বাসে অটল থেকে তিনি লেখনী হাতে তুলে নিয়েছিলেন। অসির স্থান দখল করেছিল মসি। অবরোধবাসিনী নারীসমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য মাত্র ৫ জন ছাত্রী নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ছিল প্রকৃত অর্থে নারী জাগরণের একটি প্রতীক, যাকে কেন্দ্র করে পরবর্তী কালে গড়ে উঠেছিল বিরাট কর্মযজ্ঞ। বেগম রোকেয়ার সমাজসচেতনতা ছিল সুতীক্ষ্ণ দূরদর্শিতা ও কল্যাণ কামনায় অভিষিক্ত। পশ্চাৎপদ, ধর্মান্ধ সমাজের প্রবল বাধার মধ্যেও তিনি ধৈর্য, নিষ্ঠা ও সহনশীলতার সঙ্গে ভবিষ্যতের রূপরেখা অঙ্কিত করেছিলেন। এই যুগের নারীদের কাছে এটি রূপকথার মতোই। কিন্তু সে ছিল এক জীবন্ত ইতিহাস।

মুসলিম নারী শিক্ষার কথা আলোচনা করতে গেলে বেগম রোকেয়ার জন্মের আগের নারীদের ইতিহাস একটু আলোচনা করতেই হয়। এমন এক যুগ ছিলো সেদিন, মুসলিম নারীসমাজ ছিলো সম্পূর্ণ অসূর্যস্পশ্যা। বই হাতে নেওয়া কথাটাই তখন এদের জন্য পাপের আঁধার। তখনকার সেই সময়টাতে পুরুষশাসিত সমাজ ছিল মধ্যযুগীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত। কুসংস্কার আর গোঁড়ামির ওপর ভিত্তি করে দোর্দণ্ড প্রতাপে সমাজপতিরা সমাজব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। সমাজের কঠোর অনুশাসন, অন্ধ কুসংস্কার, সংকীর্ণ স্বার্থ-বুদ্ধির জন্য নারীর জীবনের সম্ভাবনাকে, নারীর আলাদা সত্তাকে কোনো রকমের স্বীকৃতি দেওয়া হতো না। শাস্ত্রীয় বিধান আর সামাজিক অনুশাসনের দোহাই দিয়ে স্বামীর পদ সেবা, সন্তান উৎপাদন, গৃহের ৪ দেয়ালের মধ্যে বন্দী থাকার মধ্যেই বিচার করা হতো নারী জীবনের সার্থকতা। কিন্তু এখন সে যুগের অবসান ঘটেছে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন, স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন স্বার্থান্বেষী পুরুষসমাজ আজ নারীর আলাদা অস্তিত্বকে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে। সমাজের কঠিন অনুশাসন আর প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে, শত বাধার প্রাচীর পেরিয়ে এই বীর নারী দৃঢ়তার আর সা্হসিকতার সঙ্গে অবহেলিত নারীসমাজকে সর্বপ্রথম আলোর পথ দেখালেন।

নারী শিক্ষা, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ানারী শিক্ষা, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া
মহীয়সী বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ গ্রামে সম্ভ্রান্ত সাবের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মুহম্মদ নুর সাবের জহীরউদ্দিন মুহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের ছিলেন বিদ্বান। কিন্তু অত্যন্ত রক্ষণশীল, আভিজাত্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তি। মা রাহাতুন্নেছা সাবেরা চৌধুরানী ছিলেন গৃহিণী। মা-বাবার দিক থেকে বেগম রোকেয়া উচ্চবংশীয় ও জমিদার শ্রেণিভুক্ত।

কুর্সিনামা থেকে জানা যায়, তার পূর্বপুরুষ ইরানের তাব্রিজ শহর থেকে ভাগ্যান্বেষণে ভারতবর্ষে আসেন ও পায়রাবন্দে জমিদারি স্থাপন করেন। পায়রাবন্দের জমিদারি সম্বন্ধে রোকেয়া বলেন, ‘আমাদের অবস্থা সচ্ছ্বল ছিল-আমরা খাইয়া পরিয়া, গা ভরা গহ্নায় সাজিয়া থাজিতাম। কোথায়? আমাদের এ অরণ্য বেষ্টিত বাড়ির তুলনা কোথায়? সাড়ে তিন বিঘা লাখেরাজ জিম্মির মাঝখানে কেবল আমাদের এই সুবৃহৎ বাটী’।

৫ কৃতী নারীকে বেগম রোকেয়া পদক দিলেন প্রধানমন্ত্রী৫ কৃতী নারীকে বেগম রোকেয়া পদক দিলেন প্রধানমন্ত্রী
এ রকম কঠিন হেরেমে বন্দী তার প্রতিভাসম্পন্ন শিশুমন সারাক্ষণ আলো খুঁজে ফিরত। গভীর রাতে মোমবাতির মৃদু আলোয় শিশু মনের জ্ঞান তৃষ্ণা নিবারণে সাহায্য করতেন তার আপন বড় দুই ভাই-বোন। তারা লুকিয়ে লুকিয়ে বোনকে সাহায্য করতেন। দুই ভাই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। বড়ভাই ইব্রাহিম সাবের তাকে ইংরেজি শিক্ষা লাভে উৎসাহ দিয়ে বলতেন, বোন,এই ইংরেজি ভাষাটা যদি শিখতে পারিস, তাহলে তোর সামনে এক রত্ন ভাণ্ডারের দ্বার খুলে যাবে। আর বড়বোন করিমুন্নেসার কাছ থেকে বাংলা শিখেছিলেন। প্রাথমিক এই গৃহ শিক্ষাই পরবর্তী জীবনে অনেকটা বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রের পথরেখা একে দিয়েছিল। রক্ষণশীল অথচ সাহিত্যানুরাগী বাবাও এক সময় কিছুটা সহানুভূতিশীল হলেন। আর তাই কন্যাকে কিছু কিছু বাংলা শেখানোর ব্যাবস্থাও করে দিলেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৮৯৬ সালে পাটনা জেলার ভাগলপুরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট , খান বাহাদুর সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বেগম রোকেয়ার বিবাহ হয়। উচ্চশিক্ষিত বিত্তবান উদারচিত্ত সাখাওয়াত হোসেন রোকেয়ার শিক্ষানুরাগকে প্রীতির চোখেই দেখলেন। স্বামীর অপার অনুকূল উৎসাহোদ্দীপনা, অনুপ্রেরণা রোকেয়ার চিন্তা ও কর্মের জগতকে, তার উচ্চশিক্ষার পথকে সহজ করে দেয়। স্বামীর প্রচেষ্টায় রোকেয়ার মানস চক্ষু আরও উন্মীলিত হতে লাগল। স্বামী তাকে নিয়ে দেশে-বিদেশে ভ্রমণ করেছেন বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরে দিয়েছেন রোকেয়ার অন্তরকে। খুলে দিলেন তার চোখের তারার স্বপ্নীল জগতকে। স্বামীর আপ্রাণ চেষ্টায় রোকেয়ার কাব্য সাধনা শুরু হলো। খুব দুর্ভাগ্যবশত তাদের দুটি কন্যা জন্মের পর কয়েক মাসের মধ্যেই মারা যায়।

৫ বছর বয়স থেকেই এই পরিবারের সন্তান হিসেবে তাকে কঠিন পর্দার অন্তরালে বসে তাকে তোতা পাখির মতো আরবি-ফারসি বয়ান মুখস্ত শেখা ছাড়া আর কোনো বই হাতে নেওয়া ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ সম্পর্কে বেগম রোকেয়ার উক্তি ‘বাচ্চাওয়ালা মুরগি আকাশে চিল দেখিয়া ইঙ্গিত করিবা মাত্র তার ছানাগুলো মায়ের পাখার নিচে লুকায়, আমাকেও সেইরূপ লুকাইতে হইত।’

১৯০৯ সালে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে তার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন মৃত্যুবরণ করলে বেগম রোকেয়া বৈধব্য জীবন বেছে নেন এবং ভাগলপুরের ভিটামাটি ছেড়ে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন। সমাজসেবামূলক কাজে ও সাহিত্য চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রগতিশীল রোকেয়া নারী স্বাধিকার ও সম অধিকারের প্রবক্তা ছিলেন। বাংলার মুসলিম নারী সমাজের অগ্রগতি সাধনের জন্য ১৯১৬ সালে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ নামে একটি মুসলিম মহিলা সমিতি স্থাপন করেন। এই সমিতির কার্যক্রম সম্পর্কে সূফি মোতাহার হোসেন তার ‘বেগম রোকেয়া’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘জাতিগঠনমূলক কাজের জন্য আঞ্জুমান নাম ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। আঞ্জুমান অজস্র বিধবা নারীকে অর্থ-সহায়তা করেছে।চরিত্রহীন স্বামীর অত্যাচার থেকে বহু অসহায় বধূকে রক্ষা করেছে। বয়ঃপ্রাপ্ত দরিদ্র কুমারীকে সৎপাত্রস্থ করেছে। অভাবগ্রস্থ মেয়েদের শিক্ষাগ্রহণে নানাভাবে সাহায্য করেছে।’

২৩ বছরের বৈধব্য জীবনে তার এই সব প্রতিভার স্ফূরণ ঘটে। মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে তার শিক্ষা বিস্তার প্রচেষ্টা, নিরলস সাহিত্য চর্চার ভেতর দিয়ে পুরুষশাসিত কুপমণ্ডূক সমাজের গণ্ডি থেকে অবগুণ্ঠনবতি ও অবরুদ্ধ মুসলিম নারীকে মুক্ত করতে যে মহতি প্রয়াস তিনি করেন, যা তার অসাধারণ প্রতিভা ও সমাজ সচেতনতারই পরিচায়ক।

বৈচিত্র্যময় প্রতিভার অধিকারী, বাংলার মুসলিম সমাজের এক বিরল ব্যক্তিত্বের ছিলেন বেগম রোকেয়া। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর এই মহীয়সী নারীর মহাপ্রয়াণ ঘটে।

বিজ্ঞাপন

BONOLOTA IT POS ads