পুলিশের মতো কঠিন পেশায় থেকেও পশু-পাখির প্রতি ভালোবাসার এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন কুষ্টিয়া ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস (৩৬)। পেশা হিসেবে পুলিশের চাকরি এমনিতেই অনেক কঠিন। তার ওপর পেশা যদি হয় ট্রাফিক পুলিশের তাহলে তো কথাই নেই। তারপরও কঠিন এই পেশার ফাঁকেই বছরের পর বছর প্রতিদিন নিয়ম করে শত শত পাখিদের নিজ হাতে খাবার খাওয়াচ্ছেন পাখিপ্রেমী পুলিশ কর্মকর্তা মৃত্যুঞ্জয়।
অভুক্ত পাখিদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার পাশাপাশি পাখিদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল গড়ে দেওয়া, নির্বিচারে পাখি শিকার বা পাখি নিধন বন্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টিসহ পাখিদের অভয়ারণ্য গড়ে তোলারও কাজ করে যাচ্ছেন মৃত্যুঞ্জয়। এসব কিছুই তিনি করছেন পশু-পাখিদের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা থেকে।
পকেটের টাকা খরচ করে এভাবে বছরের পর বছর ধরে পাখিদের মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছেন মৃত্যুঞ্জয়। এ কাজে আলোচনা-সমালোচনারও যেন শেষ নেই। ভূয়সী প্রশংসার পাশাপাশি সাধারণ মানুষ এমনকি সহকর্মীদের অনেকেই তাকে পাগল বলে মন্তব্য করে থাকেন। তবে প্রখ্যাত উপস্থাপক হানিফ সংকেত পাখি প্রেমী মৃত্যুঞ্জয়কে নিয়ে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে একটি প্রতিবেদন প্রচার করার পর থেকে মৃত্যুঞ্জয় এখন রীতিমত ভাইরাল।
‘জীবে প্রেম করে যে জন, সে জন সেবিছে ঈশর’ এই বাক্যটি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন মৃত্যুঞ্জয়। ছোট বেলা থেকেই মৃত্যুঞ্জয় পশু-পাখিদের প্রতি একটা আলাদা টান অনুভব করতেন। কিন্তু পাখিদের নিয়ম করে প্রতিদিন দুবেলা খাওয়ানোর গল্পের শুরু ২০২০ সালে।
মত্যুঞ্জয় জানান, তখন করোনা মহামারি চলছে। কর্মস্থল চুয়াডাঙ্গা জেলা ট্রাফিক পুলিশে ছিলেন তিনি। করোনার বিধিনিষেধের কারণে খাবারের হোটেল-রেস্তরাঁ, দোকান-পাট সব কিছুই বন্ধ। এরকম একদিন আমি পাখিদের অনেক কিচিরমিচির শব্দ শুনতে পাই। তখন আমার উপলদ্ধি হয় পাখিরা হয়ত অভুক্ত। ক্ষুধার জ্বালায় তারা এরকম করছে। এরকম উপলদ্ধি থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের কোনো এক সকালে চুয়াডাঙ্গা শহরের শহীদ হাসান চত্বরে পাখিদের খাবার দেওয়া শুরু করি। চানাচুর, মুড়ি, বিস্কুটের গুড়া ছিটানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই দল বেঁধে পাখিরা খাবারের জন্য ছুটে আসত। এভাবে নিয়ম করে প্রতিদিন দুবেলা সকাল-বিকেল পাখিদের খাবার দিতাম।
এভাবেই শুরু হয় মৃত্যুঞ্জয়ের পাখিদের প্রতি ভালোবাসার এক অন্য রকম গল্প। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে মৃত্যুঞ্জয় চুয়াডাঙ্গা থেকে বদলি হয়ে কুষ্টিয়া ট্রাফিক পুলিশে যোগদান করেন। বাসা ভাড়া নেন শহরের চৌড়হাস মোড় এলাকায়। চুয়াডাঙ্গা জেলার মতো কুষ্টিয়াতেও মৃত্যুঞ্জয় প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে নিজ হাতে পাখিদের খাবার দিয়ে আসছেন। তার ব্যবহৃত সরকারি মোটরসাইকেলের দুই পাশের বক্সে সব সময় পাখিদের জন্য খাবার মজুদ থাকে। ভোরের আলো ফুটে বের হতে না হতেই চাবি দিয়ে তালাবদ্ধ বাক্স খুলে প্যাকেট করা খাবার খুলে পাখিদের মাঝে ছিটিয়ে দেন মৃত্যুঞ্জয়। আর শত শত শালিক আর কাক ছুটে এসে সে খাবার খেতে থাকে। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
শুধু পাখি নয়; পশুদের প্রতিও একই রকম মমত্ববোধ কাজ করে মৃত্যুঞ্জয়ের। গত ১৬ আগস্ট কুষ্টিয়া শহরের মজমপুর গেটে ডিউটিরত অবস্থায় একটি ক্ষুধার্ত বানরকে নিজ হাতে কলা আর পাউরুটি খাওয়াতে দেখা যায় মৃত্যুঞ্জয়কে।
এছাড়া নির্বিচারে পাখি শিকার বন্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজও করে যাচ্ছেন মৃত্যুঞ্জয়। মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়ি মাগুরা সদর উপজেলার চেঙ্গারডাঙ্গা গ্রামে। সেখানে তিনি পাখি শিকার বন্ধ ও জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নিজ উদ্যোগে ২০১৪ সালে গড়ে তুলেছেন ‘বিহঙ্গ বিলাস’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
মৃত্যুঞ্জয় জানান, সংগঠনটির উদ্যোগে নিজ এলাকায় পাখি শিকার বন্ধে সাইকেল র্যালি, লিফলেট বিতরণসহ নানা কর্মসূচি তারা পালন করে আসছেন।
উদাহরণ হিসেবে তিনি জানান, মাগুরা সদর উপজেলার কুচিয়ামোড়া ও শালিকা উপজেলার আড়পাড়া এবং বুনগাতী ইউনিয়নের প্রায় ১০টি ইউনিয়ন ঘেঁষে বুরাইল বিলের বিস্তৃতি। ফটকি নদী ঘেঁষা বুরাইল বিলে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে শামুককোল, পাতিসরাইল, পানকৌড়ি, কালেম, বক, ডাহুকসহ নানা প্রজাতির পাখি এসে ভিড় করে থাকে। এই সুযোগে বিভিন্ন স্থান থেকে শিকারিরা এখানে এসে নির্বিচারে পাখি শিকার করত।
‘বিহঙ্গ বিলাস’ সংগঠনের সদস্যদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণে জেলা প্রশাসন ও বন বিভাগ চলতি বছরের ৩ আগস্ট তারিখে বুরাইল বিল এলাকাকে পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। তিনি মনে করেন এটি তাদের সংগঠনের সদস্যদের জন্য একটি অনেক বড় প্রাপ্তি।
চুয়াডাঙ্গায় কর্মরত থাকাবস্থায় ২০২০ সালে পাখিদের জন্য বাসা তৈরি করে দেওয়ার উদ্যোগ নেন মৃত্যুঞ্জয়। সে সময় চুয়াডাঙ্গা জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার মো. জাহিদুল ইসলামের সহযোগিতায় পুলিশের ৩৯টি স্থাপনায় মাটির হাঁড়ি ও পাহাড়ি বাঁশের তৈরি প্রায় ৫ হাজার পাখির বাসা বানিয়ে দেওয়া হয়।
প্রখ্যাত উপস্থাপক হানিফ সংকেত পাখিপ্রেমী মৃত্যুঞ্জয়কে নিয়ে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে গত বছর ‘পাখিদের হৃদয় করেছে জয়, পুলিশ সার্জেন্ট মৃত্যুঞ্জয়’ এই শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রচার করেন। এরপর থেকেই মৃত্যুঞ্জয়ের পাখিদের খাওয়ানোর সব ভিডিও স্যোসাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে আসছে।
মৃত্যুঞ্জয়ের পশু-পাখির প্রতি গভীর মমত্ববোধ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে কুষ্টিয়া বার্ড ক্লাবের সভাপতি পাখি বিশেষজ্ঞ এসআই সোহেল বলেন, একজন পুলিশ সদস্য হয়েও পাখির প্রতি তার যে মমত্ববোধ তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। নাগরায়নের ফলে এক প্রকার বাধ্য হয়েই পশু-পাখিরা খাবারের সন্ধানে দলে দলে ঝাঁক বেঁধে শহরে আসছে। আমাদের সবার উচিত পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এগিয়ে আসা। মানুষের পাশাপাশি পশু পাখির জন্যও একটি বাসযোগ্য পৃথিবী কাম্য।
ব্যক্তিগত জীবনে মৃত্যুঞ্জয় বিবাহিত। তিনি এক কন্যা সন্তানের জনক। তার স্ত্রী শিপ্রা রাণী মাগুরা জেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
বিজ্ঞাপন