যেখানেই থাকি হৃদয়ে বাংলাদেশ : পর্ব -২ » Itihas24.com
ঈশ্বরদী৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
ঈশ্বরদীর সবশেষ নিউজ । ইতিহাস টুয়েন্টিফোর

যেখানেই থাকি হৃদয়ে বাংলাদেশ : পর্ব -২

মেজর মোহাম্মদ আহসান হাবিব (অবঃ)
ডিসেম্বর ৭, ২০২৩ ৭:৫০ অপরাহ্ণ
Link Copied!

মনরোভিয়া তে ব্যাবসা করে লেবানিজ আর ইন্ডিয়ানরা। মিঃ মেহতার সংগে পরিচয় হলো। মেহতা আর মিসেস মেহতা মুলতঃ আইভরিকোষ্টে ব্যাবসা করে। একমাত্র ডাক্তার ছেলে দিল্লি তে থাকে। লাইবেরিয়াতে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় সে ব্যাবসা করার জন্য বউকে আইভরিকোষ্টের দায়িত্ব দিয়ে লাইবেরিয়াতে চলে আসে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে স্ক্র্যাপ (scrap) পাওয়া যায়। এই স্ক্র্যাপ দিয়েই আমাদের দেশে, ইন্ডিয়াতে লোহার রড বানানো হয়। ওর কাজ হলো স্ক্র্যাপ সংগ্রহ করা আর ইন্ডিয়া তে পাঠানো। আমাকে বাংলাদেশে স্ক্র্যপ পাঠানোর জন্য অফার দিলো। আমার এম্নিতেই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, এর মধ্যে আবার ব্যবসা! তবে চায়না একটা দেশ বটে! যেখানেই যায় সেখানেই এম্বাসি খুলে ব্যবসা শুরু করে দেয়। লাইবেরিয়াতেও তাই করেছে। মেহতা একদিন ওর বাসায় দাওয়াত দিয়ে অনেক ইন্ডিয়ান ফুড খাওয়ালো। দেখলাম বাসায় ১০/১২ জন ইউং ছেলে, মেহতার কর্মচারী। সবাই ভারতীয়। কথা বলার এক পর্যায়ে জিগ্যেস করলাম ‘এই উশৃংখল নাইট ক্লাব আর মদের দেশে তুমি ইউং ছেলেদের সংযত রাখো কেমনে?’ মেহেতা বলে ছেলেদের টাচে রাখতে হয় আর ব্যস্ত রাখতে হয়। সত্যিই একদিন সিবীচে দেখা হলো মি. আর মিসেস মেহতার সংগে। সকল দলবল নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে আনন্দ করছে। মেহতার কাছে আর একটা বিষয় শিখেছি। ব্যবসায় উন্নতি করার মূলমন্ত্র কি?

সে বলে 3D। Dashing, Dress and aDress (Address). Dashing অর্থাৎ সাহস থাকতে হবে, Dress মানে হলো সব জায়গায় মানিয়ে নিতে হবে আর Address মানে একটা ঠিকানা থাকতে হবে যাতে অন্যরা ব্যাবসা করতে ভরষা পায়। আমি বলেছি ‘কখনো ব্যাবসা করলে তোমার এই তিনটা কথা মনে রাখবো।’
শুধু মনেই রাখলাম, ব্যাবসা আর হইলো কই। 🙁

লাইবেরিয়াতে রাস্তায় বের হলে লাইবেরিয়ান মেয়েরা বাঙ্গালী ছেলেদের অনেক বেশী টিজ (tease) করে। বাংলাদেশীরা বরাবরই নিজের দেশের কালচার ও ধর্মীয় অনুশাসন ধরে রাখে। কোনভাবেই এটা জলান্জলি দেয় না। বাংলাদেশী হিসেবে এই ব্যাপারটায় আমি খুব প্রাউড ফিল করি। তারপরেও ২/১ টা ঘটনা যে ঘটে না, তা নয়। কিন্তু ধরা পড়লে নিজের টাকায় সোজা নিজের বাড়িতে চলে যেতে হয়। ওখানে লোকালি বিয়ে/লিভ টুগেদার এর পারমিশন ইউএন দিয়ে দেয়, কিন্তু শর্ত হলো ভরনপোষণ দিতে হবে। বাংলাদেশের কান্ট্রি সিনিয়র এটাকে ওভার রুলড্ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে আর কঠোর শাস্তির নির্দেশ দেয়। ধর্মীয় অনুভুতি, সামাজিক রীতি, এইডস এর ভয়, কঠোর নজরদারি আর কঠোর শাস্তির ভয়ে বাংলাদেশীরা এটা থেকে দূরে থাকতো। জার্মানির নাগরিক একজন হিউম্যান রাইটস এর কর্মকর্তা বাংলাদেশ সেক্টরে এক সেমিনার কন্ডাক্ট করে। সে বাংলাদেশীদের ধর্মীয় বিশ্বাস, পারিবারিক বিশ্বাস ও বন্ধন কথা বিস্ময়ের সাথে তুলে ধরে। তারপর নিজের কষ্ট ও দুঃখের কথা আমাদের শোনায়। সে আমাদের বলে ‘তোমাদের মতো বন্ধন যদি আমাদের থাকতো! আমার হাসবেন্ড স্পেন এ থাকে এক মহিলাকে নিয়ে। আমাদের এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়েটা এক শহরে, ছেলে আর এক শহরে নিজেদের মতো করে থাকে।’ দুঃখ প্রকাশের এক পর্যায়ে ওই কর্মকর্তা কেঁদে দিলো।
ইউরোপ আমেরিকা যেখানে আমাদের কালচার, বন্ধন নিয়ে ঈর্ষা বোধ করে সেখানে আজ আমরা আমাদের কালচার, ধর্মীয় অনুভূতি বাদ দিয়ে তাদেরকে অনুসরন করছি। আফসোস।। হায়রে আফসোস।।

মাত্র যুদ্ধ বিরতি হয়েছে। সামনেই বিদ্রোহীদের অস্ত্র জমা দেওয়ার তারিখ নির্ধারণ হয়েছে। এতোগুলো দেশ থাকলেও ইউএন হেডকোয়ার্টার বাংলাদেশের উপরেই ভরষা রেখেছে। বাংলাদেশ সুষ্ঠুভাবে অস্ত্র সমর্পণের কাজ সম্পন্ন করে। এর মধ্যেই আত্মরক্ষার্থে কিছু আনরুলি বিদ্রোহীদের সংগে যুদ্ধ করতে হয়েছে। অস্ত্র জমার পর ইলেকশন। ফেয়ার ইলেকশনের জন্য বাংলাদেশ সেখানে মুখ্য ভুমিকা রেখেছিল। উল্লেখ্য সেই ইলেকশনে জর্জ উইয়াহ পরাজিত হয়েছিল।

বুকানন হলো লাইবেরিয়ার সমুদ্র বন্দর। বুকাননে আমাদের একটা ব্যাটালিয়ন আছে। আমি এয়ার লিয়াঁজো অফিসার এর দায়িত্বেও নিয়োজিত ছিলাম। হেলিকপ্টার এ আমরা আমাদের একজন সিনিয়র অফিসার সহ বুকানন পরিদর্শনে গেলাম। হেলিকপ্টার টা আবার বিকাল ৪ টায় আমাদের ফেরৎ নিয়ে যাবে। এর মধ্যে কন্ট্রোল থেকে আমাকে জানালো কপ্টার ১ ঘন্টা ডিলে হবে। এদিকে ৪ টা প্রায় বাজে। আমাদের সিনিয়র স্যার অস্হির হয়ে গেলেন। কেউ একজন বললেন ‘এয়ার লিয়াঁজো অফিসার আহসান তো সংগেই আছে, টেনশন করবেন না স্যার।’ আমরা তখন চা খাচ্ছিলাম। আমাদের সিনিয়র বস্ টেনশনের ঠেলায় বলে উঠলেন ‘আমি চা খাবো না, তোমরা চা খাইলে খাও না খাইলে তাড়াতাড়ি খাও।’ 😀 হাসতে হাসতে আমার হাত থেকে চায়ের কাপ নীচে পড়ে যায় আর কি। প্রয়াত প্রিয় আরিফের হাত থেকে তো কাপটা পড়েই গেলো।

বুকাননে আর একবার একটা ক্যাম্পে গিয়ে ২/৩ দিন ছিলাম। ক্যাম্পটা রাবার বাগানের ভিতরে সাহেবদের পরিত্যাক্ত একটি ক্লাবে করা হয়েছিল। অপূর্ব সুন্দর। এখনো সুইমিং পুল টা আগের মতই ঝকঝকে। ক্যাম্প কমান্ডার মেজর হুমায়ুন স্যার। পূর্বে হুমায়ুন স্যারের সাথে আমি অন্য একটা দেশেও ছিলাম। স্যার আমাকে নিয়ে চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখালেন। রাবার ফ্যাক্টরিতে কি ভাবে রাবার প্রসেস করা হয় দেখলাম। একটা পরিত্যাক্ত মিশনারী তে সৈনিকরা থাকতো। ওই বিল্ডিংটা অদ্ভুত। মিশনের নানরা সেখানে থাকতো একসময়। বিল্ডিং এর ভিতরে প্রবেশ করলে বাইরের সব কিছু দেখা যায় কিন্তু বাইরে থেকে বিল্ডং এর ভিতরে কিছুই দেখা যেতো না। তারপর বিভিন্ন সিবীচে ঘুরে বেড়াতাম।

বিকালে সুইমিং পুলে সাতার কাটতাম। আর রাতভর গল্প হতো। স্যারের গল্পই ছিলো তার পরিবার কে নিয়ে। ফুটফুটে দু’টি কন্যা। মেয়েদের অসংখ্য ভিডিও ছিলো স্যারের কালেকশনে। আমাকে ভিডিওগুলো দেখাতেন। স্যারের কথা খুব মনে পড়ে। বিডিআর বিদ্রোহের হত্যাকান্ডে স্যার শহীদ হন। লাইবেরিয়াতে আমার প্রথম হাউজমেট মেজর আজহার স্যারও বিডিআর হত্যাকান্ডে শহীদ হ’ন। অসম্ভব ভালো মানুষ ছিলেন এই দু’জন। কত স্মৃতি তাদের সাথে। বেনিনের বিমান দূর্ঘটনায় বাংলাদেশী অফিসারদের নিহিত হওয়ার ঘটনাও হয়তো অনেকেই জানেন। আসলে মানুষের স্বপ্ন যে কত তাড়াতাড়ি ভেংগে যেতে পারে, সেটা মানুষ ভাবতেও পারে না। মৃত্যু এমন এক সত্য যা আমাদের সবাইকে একদিন বরন করতেই হবে। কিন্তু সময়টা কেউ জানে না। তবুও আমাদের কত অহংকার। সমরেশ মজুমদারের একটা বিখ্যাত উক্তি দিয়ে আজকের পর্ব শেষ করি ” মৃত্যু কি সহজ, কি নিঃশব্দে আসে অথচ মানুষ চিরকালই জীবন নিয়ে গর্ব করে যায়।”

চলবে….মেজর মোহাম্মদ আহসান হাবিব (অবঃ) এর লেখা প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

মেজর মোহাম্মদ আহসান হাবিব (অবঃ)  এর ফেসবুক পোস্ট থেকে সংগ্রহীত।

বিজ্ঞাপন

BONOLOTA IT POS ads