‘রেনু আমার পাশে না থাকলে এবং আমার সব দুঃখকষ্ট, অভাব-অনটন, বারবার কারাবরণ, ছেলে-মেয়ে নিয়ে অনিশ্চিত জীবনযাপন হাসিমুখে মেনে নিতে না পারলে আমি আজ বঙ্গবন্ধু হতে পারতাম না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও যুক্ত থাকতে পারতাম না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় সে আদালতে নিত্য হাজিরা দিয়েছে এবং শুধু আমাকে নয়, মামলায় অভিযুক্ত সবাইকে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে। আমি জেলে থাকলে নেপথ্যে থেকে আওয়ামী লীগের হালও ধরেছে।’
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব (রেনু): বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের কতটা জায়গাজুড়ে তা এই কয়েকটি বাক্য পড়লেই স্পষ্ট হয়ে যায়। এ কথা সর্বজনবিদিত যে বঙ্গবন্ধুর কোনো পিছুটান ছিল না বলেই তিনি দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করে যেতে পেরেছিলেন। তার এই চলার পথে বাধা তো নয়-ই, বরং মসৃণ করেছিলেন স্ত্রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা। আর এ কারণে তিনি বাঙালি মনে সব সময় মহীয়সী নারী হয়ে থাকবেন।
১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বাংলার মানুষের কাছে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার নাম। তার ডাকনাম ছিল রেনু। বাবা শেখ জহুরুল হক ও মায়ের নাম হোসনে আরা বেগম। পাঁচ বছর বয়সে তার বাবা-মা মারা যান। তিনি তার স্বামী শেখ মুজিবুর রহমানের চাচাতো বোন ছিলেন। শেখ মুজিবের বয়স যখন ১৩ ও বেগম ফজিলাতুন্নেছার বয়স যখন মাত্র তিন, তখন পরিবারের বড়রা তাদের বিয়ে ঠিক করেন। খুব অল্প বয়সেই তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- ‘আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার তের বছর হতে পারে। রেনুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।’ রেনুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরুব্বির হুকুম মানার জন্যই রেনুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না। রেনুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে।’
সেই ছোট্ট রেনুই আমাদের বঙ্গমাতা, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ফার্স্ট লেডি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তো বটেই বঙ্গবন্ধুর পুরো রাজনৈতিক জীবনে ছায়ার মতো পাশে ছিলেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তার ত্যাগের বিনিময়েই বঙ্গবন্ধুর বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা। শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমনকি শেখ রেহানাও তাকে যেভাবে স্বীকার করেছেন, মূল্যায়ন করেছিলেন; যা তাদের লেখনীর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। বেগম মুজিব ছিলেন এক শান্ত, ধীরস্থির, ধৈর্যশীল, সাহসী, প্রজ্ঞাবান, তেজস্বিনী এবং অমায়িক এক রমনী রূপের প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শ বাস্তবায়ন করতে পেছন থেকে কাজ করেছেন রেনু। বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ যেমন একইসূত্রে গাঁথা, তেমনি জাতির বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবও পরস্পর অবিচ্ছেদ্য নাম।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু এভাবেই তার অবদান লিখছেন, ‘আমার জীবনেও আমি দেখেছি যে গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনোদিন আমার স্ত্রী বাধা দেয় নাই। এমনও দেখেছি যে অনেকবার আমার জীবনের ১০-১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনো দিন মুখ কালা কিংবা আমার ওপর প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে বোধ হয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত। এমন সময় আমি দেখেছি যে আমি যখন জেলে চলে গেছি, আমি একআনা পয়সাও দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলে মেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে।’
১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনের পক্ষে জনসমর্থন আদায় ও জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে লিফলেট হাতে রাস্তায় নেমেছিলেন বঙ্গমাতা। এসময় তিনি নিজের অলঙ্কার বিক্রি করে সংগঠনের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের নেপথ্যেও ছিল তার সঠিক দিক নির্দেশনা। আন্দোলনের উত্তাল সময়গুলোতে নিজ বাড়িতে পরম মমতায় নির্যাতিত নেতা-কর্মীর আত্মীয় স্বজনদের আপ্যায়ন করতেন, সুবিধা-অসুবিধার কথা শুনে ব্যবস্থা নিতেন। বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশে বঙ্গমাতা বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের মা।’ অনেক বীরাঙ্গনাকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়ে সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন জীবনদান করেন তিনি।
যখনই আমরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কথা বলি তখনই বঙ্গমাতার নাম প্রচ্ছন্নভাবে চলে আসে। পারিবারিক সূত্রে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। খোকা থেকে মুজিব, মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু এবং সবশেষে বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা হয়ে ওঠা সবকিছুতেই রয়েছেন আমাদের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন এবিএম মুসার ভাষ্যমতে, ‘সেই কাহিনী নেহাত কিংবদন্তি নয়, হলেও সেই কিংবদন্তি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ভেস্তে যাওয়ার ইতিহাস ভিত্তিক ক্যান্টনমেন্টে বসে শেখ সাহেব কী ভাবছেন, কেউ তা জানে না। সারাদেশের মানুষও কিছুটা বিভ্রান্ত। তারা প্রাণ দিচ্ছে, রক্ত দিচ্ছে প্রিয় নেতাকে মুক্ত করে আনার জন্য, মুচলেকা দিয়ে আইয়ুবের দরবারে যাওয়ার জন্য নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন যিনি, তিনিও ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। সেদিন মুচলেকা দিয়ে নাকি নিঃশর্ত মুক্তি- এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং জানিয়েছিলেন একজন নারী। মুজিবের সহধর্মিণী, যিনি রাজনীতি বুঝতেন না; কিন্তু নিজের স্বামীকে জানতেন। বুঝতে পেরেছিলেন তার স্বামীর মানসিক দ্বন্দ্ব। বন্দি স্বামীকে চিরকুট পাঠালেন। হাতে বঁটি নিয়ে বসে আছি প্যারোলে মুচলেকা দিয়ে আইয়ুবের দরবারে যেতে পারেন; কিন্তু জীবনে ৩২ নম্বর আসবেন না।
তবে বঙ্গবন্ধুর প্রেরণাদাতা ও আওয়ামী লীগে ত্রাতা হিসেবে ভূমিকা পালন ছাড়াও তাকে আলাদা মূল্যায়ন করে থাকি আমরা। আর তা হলো তিনি এমন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার জন্মদাত্রী। সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তার এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘জাতির সাহসী ও মমতাময়ী জননী হয়ে সেই রক্তের সঙ্গে নিজের রক্ত মিশিয়েছেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। কৃতজ্ঞ জাতির কাছে তিনি তাই বঙ্গমাতা। এই মহীয়সী নারীর জীবন পরম গৌরবের। একদিকে তিনি জাতির পিতার স্ত্রী, শহীদ সন্তানদের জননী এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একজন শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেত্রী শেখ হাসিনারও জন্মদাত্রী।’
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। রাজনীতিতে তো বটেই, রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবের লেখক হয়ে ওঠার গল্পেও রয়েছে শেখ ফজিলাতুন্নেছার অবদান। আজ যে আত্মজীবনীর (অসমাপ্ত আত্মজীবনী) আড়ালে বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে পারছি, তার নেপথ্যেও বেগম সাহেবার অনুপ্রেরণা। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমার স্ত্রী যার ডাকনাম রেনু আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেনু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম’। নিজের সহধর্মিণীর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর এমন উক্তিই অনেক বুঝিয়ে দেয়- জাতির পিতার জীবনে প্রিয় স্ত্রীর অবদান।
নিজে আপাদমস্তক গৃহিণী হয়েও স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন বঙ্গমাতা। বেগম মুজিব ছিলেন মনেপ্রাণে পূর্ণ আদর্শ বাঙালি নারী। বুদ্ধিমত্তা, শান্ত, আতিথেয়তা ও দানশীলতা তার গুণ। পরিস্থিতি মোকাবেলা করতেন অসীম ধৈর্য, সাহস ও দৃঢ়তা নিয়ে। বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর ১৪ বছরের কারাবন্দিকালে দলের কঠিন সংকট সব সমস্যার সমাধানও দিয়েছেন তিনি। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১৫ দিন অন্তর অন্তত একবার দেখা করার সুযোগ পেতেন; তাও কয়েক মিনিটের জন্য। সেখান থেকেই নানা সমাধান নিয়ে এসে দল আওয়ামী লীগে বিচক্ষণ পরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করতেন বেগম মুজিব।
নেতাকর্মীদের রোগে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, কারাগারে অন্তরীণ কর্মীদের খোঁজ নেওয়া ও পরিবার-পরিজনদের সংকটে পাশে দাঁড়ানো ছিল তার রুটিন ওয়ার্ক। এক কর্মীর আর্থিক সংকট নিরসনে নিজের হাতের বালা পর্যন্ত খুলে দিলেন। কন্যা শেখ হাসিনা তার ‘স্মৃতি বড় মধুর, স্মৃতি বড় বেদনার’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আন্দোলনের সময় বা আব্বা বন্দি থাকা অবস্থায় পার্টির কাজকর্মে বা আন্দোলনে খরচের টাকাও মা যোগাতেন। অনেক সময় বাজার হাট বন্ধ করে অথবা নিজের গায়ের গহনা বিক্রি করেও মাকে দেখেছি সংগঠনের জন্য অর্থের যোগান দিতে।’ সুখে-দুঃখে বঙ্গবন্ধু ও তার প্রিয় দল আওয়ামী লীগের সারথি হিসেবে তার এই অবদান জাতি কোনোদিন ভুলবে না।
স্বীকার করতেই হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও অনুপ্রেরণাদায়ী নারী হলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিনি শুধু শেখ মুজিবের সহধর্মিণী নন, তার পরিচয় আমাদের কাছে বন্ধু, পরামর্শক, সমর্থক এবং সহায়ক হিসেবেও। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে রাজনীতিতে স্মরণীয় সাফল্য অর্জন করা অসম্ভব হতে পারত, যদি বেগম মুজিব তার সঙ্গে না থাকতেন। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ‘বঙ্গমাতা : ইতিহাস সচেতনতার মানুষ’ নিবন্ধের ভাষায়, ‘তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে একজন সাহসী নারী। দুর্বার সাহসে ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে দিয়েছিলেন দূরদর্শী চিন্তার বার্তা। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ ফেলার সাহসী বার্তা তাকে ইতিহাসের মানুষ করেছে। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে জেন্ডার সমতার ইতিহাসে তিনি আমাদের অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের মানুষ।’
সবশেষে একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। ১৯৪৬ সাল। দাঙ্গা চলছে। সে সময় বেগম মুজিব নিজে অসুস্থ থাকলেও স্বামীকে দাঙ্গা এলাকায় যেতে বারণ করেননি। ওই সময় স্বামীকে লেখা বেগম মুজিবের একটি চিঠি আমরা দেখতে পাই। তিনি লিখেছেন, ‘আপনি শুধু আমার স্বামী হবার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্য জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিন্তমনে সেই কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লাহর ওপর আমার ভার ছেড়ে দিন।’
এই হলো বঙ্গমাতা উপাধি পাওয়া আমাদের ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুর জীবনে তিনি যেমন আলোকবর্তিকা, তেমনি আমাদের স্বাধীনতা ও দেশের মানুষের জন্য তার অবদান অনন্য অবিস্মরণীয়। সেদিন যদি তিনি এই সাহসী ভূমিকা পালন না করতেন, তবে আজ হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্নভাবে রচিত হতে পারত। এভাবেই আজীবন বাংলার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণকারী সিদ্ধান্তের পেছনে ভূমিকা রেখে গেছেন এই গৃহিণী। ৯১তম জন্মদিনে মহীয়সী এই নারীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুভাষ সিংহ রায়